একটি শহর, এক দাবি, এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা

এম. এ. বাকী বিল্লাহ: কলামিস্ট ও সংগঠক

 

একটি হুইসেলের শব্দ—যা মুহূর্তেই পরিণত হলো আতঙ্কের প্রতীকে। একটি পাথর—যা হয়ে উঠলো প্রতিরোধের অযাচিত প্রতীক। আর একটি শহর—ভৈরব, যার ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে হঠাৎ-ই বিকৃত করে দেখানো হলো। আজ ভৈরববাসী অনুতপ্ত, লজ্জিত, ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু অধিকার আদায়ে আশাবাদী। কারণ তারা জানে, যা ঘটেছে তা শহরের চরিত্র নয়, বরং এক অপ্রত্যাশিত ভুল বোঝাবুঝির ফল।

 

ভৈরববাসী দীর্ঘদিন ধরে “ভৈরব জেলা” ঘোষণার দাবি করছে। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের দাবি নয়, কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা নয়। এটি সাধারণ মানুষ—ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, চাকরিজীবী ও নাগরিকদের সমষ্টিগত দাবি। এককথায়, দল-মত নির্বিশেষে ভৈরববাসীর ঐক্য এই আন্দোলনের প্রাণ।

 

প্রথম দিন দুর্জয় মোড়ে শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধে শহরের নাগরিকরা অংশ নিয়েছিল। সেখানে কোনো হিংসা হয়নি; সকলেই সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নেন। পুলিশের নজরদারি ও সহমর্মী জনতার উপস্থিতিতে আন্দোলনকারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণ পথে অবস্থান নেন। এই কর্মসূচি ছিল একটি স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খল ও নাগরিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক।

 

ভৈরবের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্মারকলিপি, মিছিল ও জনসচেতনতা তৈরি করছে। সম্প্রতি আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থানীয় নাগরিক সমাজ ইউএনও অফিসের মাধ্যমে সরকারের কাছে লিখিত স্মারকলিপি প্রদান করেছে। কিন্তু সরকার এই বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি এবং কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এই উদাসীনতা ভৈরববাসীর মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে এবং অনেকে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন যে তাদের ন্যায্য দাবি আজও রাজনৈতিক প্রভাব ও উদাসীনতার শিকড়ের মধ্যে আটকা পড়েছে।

 

শান্তিপূর্ণ ব্লকেড কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি যখন ব্রিজে থেমে যায়, রেলের নিজস্ব কর্মীরা ট্রেনটি সেখান থেকে স্টেশনে নিয়ে আসে। তখন পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। আন্দোলনকারীরা সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নেন; কেউ উত্তেজিত নয়, কেউ সহিংস নয়। ঠিক তখনই ঘটলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা—ট্রেনের এমএলএম হঠাৎ হুইসেল বাজিয়ে দেন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। উপস্থিত জনতা, বিশেষ করে তরুণরা, হুইসেল শুনে ধারণা করে ট্রেন চলতে পারে; ভয়ে ছুটোছুটি শুরু হয়। এরই মধ্যে কয়েকজন কিশোর ইঞ্জিনে পাথর ছুড়ে বসে। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যে কেউ পরিস্থিতি সামলানোর সুযোগ পায়নি। প্রশ্ন জাগে, যেখানে শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচি চলছে, সেখানে হঠাৎ হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ার উদ্যোগ কতটা দায়িত্বশীল ও যৌক্তিক ছিল? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কি পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম ছিল না?

 

ভৈরব বরাবরই রেলের বন্ধু। এই শহরের জন্ম, বৃদ্ধি ও অর্থনীতি রেল ও নদীকেন্দ্রিক। দেশের অন্যতম ব্যস্ততম রেল জংশনগুলোর মধ্যে ভৈরব অন্যতম। প্রতিদিন শত শত ট্রেন আসে-যায়, হাজার হাজার যাত্রী যাত্রা করে। ভৈরববাসী কখনো রেলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেনি; বরং সহযোগী হিসেবে দেখেছে। মাত্র দুই বছর আগে, ভৈরব স্টেশনের বাইরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল ভৈরববাসী। আহতদের হাসপাতালে নেওয়া, রক্তদান, চিকিৎসা নিশ্চিত করা—সবই মানবিকতার উদাহরণ স্থাপন করেছিল তারা। ২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে হামলার সময় আতঙ্কিত যাত্রীরা আশ্রয় নিয়েছিল ভৈরব স্টেশনে। সেই সময়ও ভৈরববাসী মানবিকতার পক্ষে দৃঢ় ছিল। সেই শহরকেই আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “পাথর ছোড়া শহর” বলে অপমান করা হচ্ছে—যা অন্যায়, অবিচার ও অপমানজনক।

 

ভৈরব জেলার দাবি নতুন নয়। ২০০৯ সালে সরকারিভাবে ভৈরবকে জেলা ঘোষণার ঘোষণা করা হয় এবং প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরোধিতা, রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক জটিলতায় জেলা বাস্তবায়ন আটকে যায়। ফাইলটি লালফিতার মধ্যে পড়ে থাকা অবস্থায় বছরগুলো কেটে যায়। অথচ ভৌগোলিক, জনসংখ্যাগত, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভৈরব জেলা হওয়ার সব মানদণ্ড পূর্ণ করেছে।

 

প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ স্পষ্ট। ভৈরবের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখের বেশি। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য লেনদেন হয়। নদী, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হওয়ায় প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য আদর্শ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় শহরটি পার্শ্ববর্তী উপজেলার তুলনায় এগিয়ে। সরকারি কলেজ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেডিকেল ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান—সবই শহরের গুরুত্ব ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে। অর্থাৎ প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—সব ক্ষেত্রেই ভৈরব জেলা হওয়ার যোগ্য।

 

বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি অঞ্চলের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও লবিবাজির কারণে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ ও বাজিতপুরের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক ভৈরব জেলার বিরোধিতা করে আসছেন। কারণ জেলা হলে প্রশাসনিকভাবে কিশোরগঞ্জের প্রভাব কমে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে ভৈরবের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। নাগরিক সমাজের স্মারকলিপি, মিছিল ও সংবাদ সম্মেলনের পরও সরকারের উদাসীনতা অব্যাহত। মনে হয় যেন ভৈরববাসীর ন্যায্য দাবিকে গুরুত্ব না দেওয়া, এক ধরনের নীরব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

 

ভৈরব জেলা বাস্তবায়নের পক্ষে যুক্তি অসংখ্য। প্রশাসনিকভাবে কিশোরগঞ্জ জেলার ওপর চাপ কমবে, অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এটি সাধারণ মানুষের দাবি, রাজনৈতিক দল নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছে, যা ন্যায়ের দিক থেকে সঙ্গত।

 

সম্প্রতি ট্রেনের ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভৈরবকে টার্গেট করা হয়েছে। “ভৈরবের মানুষ রেল ধ্বংস করে” এমন উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে যাচাই না করেই পোস্ট শেয়ার করেছে। এটি কেবল ভৈরববাসীর মর্যাদার ওপর আঘাত নয়, বরং চলমান গণআন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। গণমানুষের আন্দোলনকে একক ঘটনার মাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হলো।

 

আজ ভৈরববাসী লজ্জিত—যদি কোনো ব্যক্তি ভুল করে থাকে, তবে সেটি শহরের পরিচয় নয়। কিন্তু তারা একইসঙ্গে আশাবাদী, কারণ তাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত, বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী। একদিকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর দিয়ে ট্রেন চালানোর চেষ্টা, অন্যদিকে কয়েকজন কিশোরের পাথর নিক্ষেপ—দুই ঘটনাই নিন্দনীয়। কিন্তু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার অজুহাতে দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা যায় না।

 

সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান—দল-মত নির্বিশেষে এই সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে মর্যাদা দিন। ভৈরব জেলা ঘোষণার বাস্তবায়ন শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি শহরের মর্যাদা, জনগণের আত্মসম্মান এবং ন্যায়ের প্রতিফলন। ভৈরবকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিন। কারণ, এই শহর কেবল একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়—এটি বাংলাদেশের শ্রম, শিক্ষা, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির অনন্য প্রতিচ্ছবি। যে শহর মানবিকতায় রক্ত দিয়েছে, রেলের দুর্ঘটনায় জীবন দিয়েছে, সেই শহরের দাবি আজ সময়েরও দাবি।

 

ভৈরববাসীর ধৈর্য, ঐক্য ও ন্যায্য দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সমাজ ও সরকার উভয়ের দায়িত্ব। প্রশাসনিক অক্ষমতা, পার্শ্ববর্তী রাজনৈতিক চাপ বা রাজনৈতিক উদাসীনতা যেন আর দীর্ঘদিন এই শহরের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। ভৈরব জেলা ঘোষণার পূর্ণ বাস্তবায়ন শুধু ন্যায়ের দাবি নয়, এটি দেশের প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি উদাহরণ, যেখানে সাধারণ মানুষই রাজনীতির চেয়েও বড় এবং ন্যায়ের মানদণ্ড স্থির করে।

এ রকম আরো সংবাদ

আমাদের সাথে থাকুন

0FansLike
0SubscribersSubscribe

সর্বশেষ সংবাদ